কেন পড়বে বস্তু ও ধাতব কৌশল (MME)?
তুমি কি কখনো ভেবেছো —
কেন মরিচারোধী ইস্পাত খোলা বাতাসে টিকে থাকে, কিন্তু লবণ-পানিতে মরিচা পড়ে?
কীভাবে আগ্নেয়গিরির এসিড-বাষ্পেও টিকে থাকা ধাতু তৈরি করা যায়?
অথবা, কীভাবে স্মার্টফোনের কাচ একাধারে স্বচ্ছ, মজবুত ও বিদ্যুৎ পরিবাহী হতে পারে?
এইসব প্রশ্নের উত্তরই লুকিয়ে আছে বস্তু ও ধাতব কৌশল (Materials and Metallurgical Engineering – MME) বিভাগে।
বিজ্ঞানের জ্ঞান থেকে প্রকৌশলের বাস্তবতা
MME এমন একটি প্রকৌশল শাখা যা পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের মৌলিক বিজ্ঞানকে বাস্তব প্রকৌশল সমস্যার সমাধানে প্রয়োগ করে।
এই বিভাগে শেখা হয় কিভাবে বস্তুর গঠন, উপাদান, প্রক্রিয়াকরণ ও বৈশিষ্ট্য একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং কিভাবে এই জ্ঞান ব্যবহার করে নতুন ও উন্নততর বস্তু তৈরি করা যায় — যা ব্যবহার হয় প্রায় প্রতিটি শিল্পখাতে, যেমন নির্মাণ, পরিবহন, ইলেকট্রনিক্স, শক্তি, চিকিৎসা এবং মহাকাশ প্রযুক্তিতে।
সভ্যতার ভিত্তি – বস্তুর বিবর্তন
মানব সভ্যতার প্রতিটি যুগই কোনো না কোনো বস্তুর নামে চিহ্নিত — প্রস্তর যুগ, তাম্র যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, লৌহ যুগ।
অর্থাৎ, বস্তুর উন্নয়নই সভ্যতার অগ্রগতির চালিকাশক্তি।
আজকের পৃথিবীতেও তাই – সিমেন্ট, স্টিল, প্লাস্টিক ও সিলিকন ছাড়া আধুনিক অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তি কল্পনাই করা যায় না।
MME হলো সেই বিজ্ঞান, যা এসব বস্তু উদ্ভাবন, পরিবর্তন ও প্রয়োগের জ্ঞান দেয়।
আমাদের ইতিহাস ও উত্তরাধিকার
বস্তু ও ধাতব কৌশল বিভাগ (MME) বুয়েটে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালে, আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ যুগে, উপমহাদেশে শিল্পায়নের প্রয়োজনে।
তখন প্লাস্টিক সদ্য আবিষ্কৃত, আর আধুনিক সিরামিক ও ইলেকট্রনিক পদার্থ ছিল সীমিত পরিসরে।
তবুও এ বিভাগের গবেষক ও শিক্ষকরা বাংলাদেশের ইস্পাত, খনিজ, এবং যন্ত্রাংশ শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৯৭ সালে আধুনিক চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে বিভাগের নাম হয় বস্তু ও ধাতব কৌশল, যেখানে এখন ধাতু ছাড়াও সিরামিক, পলিমার ও কম্পোজিট পদার্থ অন্তর্ভুক্ত।
বর্তমানে বিভাগে প্রায় ২০ জন শিক্ষক, অধিকাংশই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেছেন, এবং প্রতিবছর ৬০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন।
কী শেখানো হয়
এই বিভাগে শিক্ষার্থীরা শেখে—
- বস্তুর পারমাণবিক গঠন ও অভ্যন্তরীণ কাঠামো
- গঠনভেদে বস্তুর বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন
- প্রক্রিয়াজাতকরণ ও তাপ-রাসায়নিক প্রভাব
- বাস্তব প্রয়োগে পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্যের প্রভাব
শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করে ধাতু, সিরামিক, পলিমার ও কম্পোজিট পদার্থ,
এবং শিখে ন্যানোম্যাটেরিয়াল, ইলেকট্রনিক মেটেরিয়াল, স্মার্ট অ্যালয়, বায়োম্যাটেরিয়াল, ও রিসাইক্লিং প্রযুক্তি।
সঙ্গে রয়েছে মৌলিক পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, যন্ত্রকৌশল, তড়িৎকৌশল, কম্পিউটার সিমুলেশন, নৈতিকতা, অর্থনীতি ও যোগাযোগ দক্ষতা — যা একজন শিক্ষার্থীকে প্রকৃত অর্থে যোগ্য প্রকৌশলী, গবেষক ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।
গবেষণা ও কর্মক্ষেত্র
বুয়েটের MME বিভাগের শিক্ষার্থীরা গবেষণা করছে MIT, Harvard, Caltech, Oxford–এর মতো বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানে,
এবং কর্মরত রয়েছে NASA, Bell Labs, Google, Microsoft, Facebook-এর মতো নামী প্রতিষ্ঠানে।
দেশে এ বিভাগের প্রাক্তন ও বর্তমান গবেষকরা কাজ করছেন রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রো রেল, রেলওয়ে, বিদ্যুৎ, শুল্ক ও প্রতিরক্ষা বিভাগে।
অনেকে যুক্ত আছেন BCSIR, Atomic Energy Commission, ও বিভিন্ন ইস্পাত, সার, সিরামিক, ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারী কারখানায়।
অনেকে আবার উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় নিজেদের নিয়োজিত করেছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।
নতুন শতকের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
MME কেবল ঐতিহ্য নয়, এটি ভবিষ্যতের প্রযুক্তিরও চাবিকাঠি।
বিশ্ব আজ যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি —
- সবুজ স্টিল ও কার্বনমুক্ত উৎপাদন প্রযুক্তি,
- ধাতব ও ইলেকট্রনিক বর্জ্যের পুনঃচক্রায়ন,
- দুর্লভ খনিজের বিকল্প আবিষ্কার ও ন্যায্য ব্যবহার,
- কোয়ান্টাম কম্পিউটার ও অতিপরিবাহী উপাদান উন্নয়ন,
- পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী ও বায়ো–ভিত্তিক বস্তু উদ্ভাবন —
এসবের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বস্তু ও ধাতব কৌশলীরা অগ্রভাগে রয়েছেন।
কেন পড়বে MME?
MME এমন একটি বিভাগ যা অণু থেকে অবকাঠামো, গবেষণা থেকে শিল্প, ল্যাব থেকে সমাজ—সব জায়গায় সংযোগ ঘটায়।
এখানে তুমি একদিকে বিজ্ঞানের গভীর তত্ত্ব শিখবে, অন্যদিকে বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধানে তা প্রয়োগ করবে।
তোমার উদ্ভাবনী চিন্তা যদি সমাজ ও দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে চাও,
তবে MME-ই সেই জায়গা, যেখানে বিজ্ঞান রূপ নেয় প্রকৌশলে, আর প্রকৌশল বদলে দেয় বিশ্ব।
তোমার কৌতূহল, যুক্তিবোধ ও স্বপ্নের যাত্রায় — স্বাগতম বস্তু ও ধাতব কৌশলের জগতে।